ঘটনাটার শুরু প্রায় বছরখানেক আগে। গতবছরের জুনে চাকুরীর আশ্বাস দিয়ে সতেরো বছরের নাবালিকা এক কিশোরীকে বাড়িতে ডেকেছিলেন ভারতের উত্তরপপ্রদেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এক বিধায়ক। কিশোরীর পরিবারের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বিধায়কের, পাশাপাশি বাড়ি, সেই সূত্রেই হৃদ্যতা। বিধায়ককে ‘দাদু’ বলে সম্বোধন করতো কিশোরী। সেই মানুষটার হাতেই সেদিন বিকেলে ধর্ষিত হতে হয়েছিল তাকে। হুমকি দেয়া হয়েছিল, কাউকে কিছু বললে খুন করা হবে তার পরিবারের সবাইকে! সেই হুমকিতে ভয় পেয়ে চুপসে গিয়েছিল নির্যাতিতা কিশোরী, চুপচাপ বাড়ি ফিরে এসেছিল সে, কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি।
কিন্ত এর এক সপ্তাহ বাদেই তাকে আবার তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই বিধায়কের ছোটভাই আর তার বন্ধুরা। টানা কয়েকদিন আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হয় তাকে। সপ্তাহখানেক পরে সেখান থেকে পালিয়ে আসে ওই কিশোরী, ঘটনা জানাজানি হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার পদক্ষেপ নেয়া হয় তখনই। আর সেখান থেকেই এই ঘটনাটা সিনেম্যাটিক একটা রূপ নিতে শুরু করলো।
বারবার থানায় অভিযোগ জানিয়েছিল নির্যাতিতার পরিবার, কিন্ত স্থানীয় বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ হওয়ায় সেটা গ্রহণই করেনি পুলিশ। ঘটনার প্রায় মাস দশেক পর আদালতের নির্দেশে এফআইআর নিতে বাধ্য হয় স্থানীয় পুলিশ, কিন্ত এরপরপরেই সেই কিশোরী আর তার পরিবারের ওপর নেমে এলো দুর্যোগ, বিধায়কের লোকেরা হুমকি দেয়া শুরু হলো মামলা তুলে নেয়ার জন্যে। গত তেসরা এপ্রিল সেই বিধায়কের ভাই লোকজন নিয়ে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় মেয়েটির বাবাকে, জোর করে থানায় নিয়ে এফআইআর তুলে নিতে চাপ দেয়, কিন্ত সেটা করেননি তিনি। একদিন পরেই অস্ত্র আইনে মামলা দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাকে!
বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে শুনে নির্যাতিতা সেই তরুণী ছুটে গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাসভবনের সামনে, সেখানেই গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে। তবে নিরাপত্তাকর্মীরা সেই যাত্রায় নিবৃত্ত করে তাকে, আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মেয়েটাকে। এরমধ্যেই খবর আসে, জেলে আটক থাকা অবস্থায় মারা গেছেন তার বাবা! পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গ্রেফতারের আগে থেকেই নাকি তিনি অসুস্থ ছিলেন। অথচ ভদ্রলোকের পরিবার থেকে বলা হয়েছে, একদম সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষটাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ, এটা খুন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
ঘটনাটা শুনে বলিউডি সিনেমার মতো লাগছে না? প্রতাপশালী এক খলনায়কের গল্প যেন, যার চুল ছেঁড়ার সাধ্যও কারো নেই। আইন-আদালত সবকিছু পকেটে নিয়ে যিনি ঘোরেন! তবে সিনেমার গল্পে তো নায়ক থাকে, তার ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয় অশুভ শক্তি। বাস্তবের গল্পেও নায়ক আছে, সেই নায়ক জনগণ।
মূখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে তরুণীর আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনার পরেই সাড়া পড়ে যায় মিডিয়াপাড়ায়। দাবানলের মতো ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বিজেপির বিধায়ক সরাসরি ধর্ষনকাণ্ডে জড়িত, মানুষের জন্যে এটা মেনে নেয়া সহজ কিছু নয়। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতে সময় লাগেনি খুব বেশী। এদিকে সেই বিধায়ক, কূলদীপ সিং সেনগার।বুক ফুলিয়ে মিডিয়ার সামনে এসে বলে গিয়েছেন, এসবকিছুই তার বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় ষড়যন্ত্র! মূখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদও পাচ্ছিলেন তিনি, একারণেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে যখন পুলিশের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চায়, স্থানীয় পুলিশ সুপার তাকে ‘মহামান্য বিধায়ক’ বলেও সম্বোধন করেন!
থানা হাজতে কিশোরীর বাবার মৃত্যুর খবরটা যেন বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। ময়নাতদন্তে নিহতের শরীরে চৌদ্দটা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। এই খবরের পর থেকেই রাস্তায় অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। উত্তরপ্রদেশের জেলায় জেলায় আন্দোলন চলছিল, বিক্ষোভ মিছিল থেকে সরাসরি অভিযোগ তোলা হচ্ছিল মূখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে, কেন তিনি প্রশ্রয় দিচ্ছেন অপরাধীকে। দিল্লিতেও বিক্ষোভ কর্মসূচী হয়েছে, হয়েছে মানববন্ধন। ঘটনা গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাঠগড়া পর্যন্ত, বিরক্ত মোদি দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছেন মূখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথকে।
বিজেপির রাজনীতিটা বরাবরই ধর্মকেন্দ্রিক। ওদের হাতে ট্রাম্পকার্ড বলতে দলের শীর্ষ নেতাদের একজনকে সবার সামনে হিন্দুত্ববাদের পোস্টারবয় বানিয়ে দেয়া। এককালে অটল বিহারী বাজপেয়ী ছিলেন, এখন নরেন্দ্র মোদী, আর তার উত্তরসূরী হিসেবে যোগী আদিত্যনাথের নামই শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে। একারণে যোগীর সঙ্গে মোদির সম্পর্কটা খানিকটা আদায়-কাঁচকলায়। সেই মোদিই এই কেসটা পুলিশের হাত থেকে সিবিআইয়ের কাছে স্থানান্তর করার নির্দেশ দিলেন, একদিনের ব্যবধানে সেই নির্দেশ পালিতও হলো।
এরপরে থেকেই ঘটনার মোড় ঘোরা শুরু হয়ে গেল। যোগী যেদিন মোদির সঙ্গে দেখা করতে দিল্লী গেলেন, সেদিনও বড় গলায় নিজেকে নির্দোষ দাবী করেছিলেন অভিযুক্ত বিধায়ক কূলদীপ। যোগী রাজ্যে ফিরতেই অবস্থানটা বদলে গেল, ঘোষণা দেয়া হলো, অপরাধী যে’ই হোক, তাকে ছাড় দেয়া হবে না। পরদিন আবার কোর্টে রাজ্যপক্ষের উকিল বললেন, তাদের হাতে নাকি কূলদীপকে আটক করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই! তখনও কেস সিবিআইয়ের হাতে পড়েনি। সেদিন সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে সিবিআইকে এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়, তারা দায়িত্বভার গ্রহণ করলো পরদিন, গত ১২ই এপ্রিল।
চব্বিশ ঘন্টা পার হবার আগেই এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ১৩ই এপ্রিল ভোরবেলায় কূলদীপকে আটক করলো সিবিআই। যে কাজটা ভারতের পুলিশ দশমাসে করতে পারলো না, সেটা দশ ঘন্টায় করে দেখালো সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনস! সকালে আদালতকে জানানো হলো, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আটক করা হয়েছে অভিযুক্ত বিধায়ককে, দুই বিচারকের সুস্পষ্ট জবাব ছিল- আটক ফাটকের নাটক করার দরকার নেই, আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করুন তাকে। সাতদিনের জন্যে সিবিআই হেফাজতে রাখা হবে কূলদীপকে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। আগামী ২রা মে’র মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে সিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
এইসব অপরাধীরা বাস করেন সমাজের ওপরতলায়, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান রাজনৈতিক ছত্রছায়ার আশ্রয় পেয়ে। চারবার বিধায়ক নির্বাচিত হওয়া কূলদীপ যেমন ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন, অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়াটা যেখানে নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা, সেখানে কূলদীপদের এমন আস্ফালন তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সবকিছুর যে একটা সীমা আছে, পাপ করলে যে সেটার সাজা পেতে হয়, এই জিনিসটাই কূলদীপ সিং সেনগারকে জানিয়ে দিলো ভারতের মানুষ। সিবিআইয়ের ইন্টারোগেশন সেলে এখন গলাবাজী কতটা করতে পারছেন কূলদীপ, সেটা দেখার ইচ্ছে হচ্ছে খুব!