ক্যান্ডিডো অরটিজ দাবি করেন, তিনি সব ধরণের রান্নাতেই সমান পারদর্শী। আলু ভর্তা থেকে শুরু করে গ্রেভি, কিংবা পারনিল গিজাডো বা চিকেন ক্যাচাতোরে – তাকে যেকোন ডিশ রেঁধে দিতে বলেন, তিনি ঠিকই সেটি রেঁধে আপনার সামনে এনে হাজির করবেন। তিনি একটি নতুন রেঁস্তোরা খুলেছেন, নাম ‘এল সাবার দেল ক্যাফে’। সেখানে তিনি হাসিমুখে মেটাবেন ক্রেতাদের যেকোন খাবারের আবদার।
কিন্তু অরটিজ তার এই অসাধারণ রন্ধনশৈলীর দীক্ষা কোত্থেকে নিয়েছেন, জানলে অবাক না হয়ে পারবেন না। রান্না টুকটাক আগে থেকেই জানতেন তিনি। কিন্তু রান্নার ব্যাপারে নিজের দক্ষতাকে সাধারণের থেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি একটি ফেডারাল প্রিজনে বসে, যেখানে তাকে বন্দি থাকতে হয়েছে ২৬ বছর, ১০ মাস, ১৭ দিন। এবং এই দীর্ঘ মেয়াদের প্রায় ২৪ বছরই তিনি সেখানে কাটিয়েছেন একজন রাঁধুনী হিসেবে।
আসলে খুব অল্পের উপর দিয়েই পার পেয়ে গেছেন অরটিজ। কোকেইন চোরাকারবারীর দলের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে তার সাজা হয়েছিল ৪৯ বছর ৬ মাসের। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদের অর্ধেকের সামান্য বেশি সময় পরই তিনি আবার ফিরে আসতে পেরেছেন স্বাধীন, মুক্ত পৃথিবীতে।
বর্তমানে ৫৭ বছর বয়স চলছে অরটিজের। যখন কারাবন্দি হয়েছিলেন, তখন সবে ৩০ পেরোনো এক টগবগে যুবক তিনি। ‘প্রথম যখন জেলে গেলাম, আমার সাজার একেবারে শুরুর দিকে, আমি ভাবতাম আর বোধহয় জীবনেও এখান থেকে ছাড়া পাব না।’ কিন্তু অরটিজের সেই আশংকা শেষমেষ অমূলক প্রমাণিত হয়। গত বছর তিনি সসম্মানে বেরিয়ে আসেন নিউ জার্সির ফোর্ট ডিক্সে অবস্থিত ফেডারাল কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি থেকে। কারণ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন তাকে।
তবে মুক্তি পেলে কি হয়েছে, পরিস্থিতি খুব একটা অনুকূলে ছিল না অরটিজের। কারণ তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন একেবারেই কপর্দকশূন্য অবস্থায়। তার এমন কোন নিকটাত্মীয়ও ছিল না যারা তাকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করবে। কোন অফিসিয়াল আইডেন্টিফিকেশন যেমন ছিল না, তেমনি কোন কাজের ব্যাপারে পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিল না।
সেই সময়ে অরটিজের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় নিউ জার্সি রি-এন্ট্রি কর্পোরেশন, নিউ জার্সির সাবেক গভর্নর জেমস ই ম্যাকগ্রিভি পরিচালিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরেই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পাঁচদিনের মাথায় অরটিজ ফিরে যেতে পারেন নতুন আরেকটি রান্নাঘরে। একজন রাঁধুনী হিসেবে তার চাকরি হয় জার্সি সিটির দ্য লাইট রেইল ক্যাফে রেঁস্তোরাতে।
জীবনের বিশাল একটি সময় অরটিজ হারিয়েছেন জেলখানার চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থেকে। সেখানে তিনি নিজেকে রান্নার কাজে ব্যস্ত রাখলেও, সেখানে কাজের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, যার সাথে সাধারণ জীবনযাত্রার বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই। ফলে একজন সাধারণ চাকুরিজীবীর জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছিল তাকে।
অরটিজ বলেন, ‘আমি আমার মালিককে শুরুতেই বলে রেখেছিলাম, এখানে বেশিদিন থাকছি না আমি। নিজের একটা জায়গা হলেই এখানকার কাজ ছেড়ে দেব। জবাবে তিনি বলেছিলেন, “তাই নাকি?” তিনি ভেবেছিলেন আমি তার সাথে মজা করছি। কিন্তু আমি মোটেই মজা করছিলাম না। আমি খুবই সিরিয়াস ছিলাম।’
এবং বছরখানেক সংগ্রামের পর, নিজের সঞ্চিত অর্থ আর নিউ জার্সি রি-এন্ট্রি কর্পোরেশন থেকে পাওয়া ২৫,০০০ ডলারের অনুদান নিয়ে অরটিজ চালু করে ফেলেছেন তার নিজের রেঁস্তোরা, তাও আবার ঠিক বড়দিনের মৌসুমে। তাই সবমিলিয়ে তার স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার যাত্রাটা যে বেশ ভালোই হচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, মাদক চোরাচালানের সাথে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন অরটিজ? সে ব্যাখ্যা শুনুন তার নিজের মুখ থেকেইঃ ‘যখন বয়স কম ছিল, স্বভাবতই দ্রুত টাকা উপার্জনের একটা তাড়না কাজ করত মনের ভেতর। রাস্তায় যেসব শৌখিন গাড়ি ঘুরে বেড়াত, সেগুলোর একটা পেতে ইচ্ছা করত, নিজেও সেটা চালিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করত। দ্রুত টাকা উপার্জনের তাড়না থেকেই আমি মাদক কেনাবেচা শুরু করি। আর তাতে টাকাও আসতে থাকে ঝড়ের বেগে। প্রচুর টাকা উপার্জন করছিলাম আমি। চাইলেই যেকোন কিছু কিনতে পারতাম।’
কিন্তু তার সেই সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৯০ সালে কোকেইন চোরাচালান ও সঙ্গে ফায়ার-আর্মস বহনের অপরাধে গ্রেপ্তার হন তিনি। এবং যখন তিনি প্রথম জেলখানায় আসেন, তিনি ছিলেন উগ্র ও বদমেজাজের এক যুবক। কয়দিন পরপরই নতুন নতুন সব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তেন তিনি। কিন্তু বছরখানেক পরই মানসিকভাবে শান্ত হতে শুরু করেন তিনি। তিনি উপলব্ধি করেন, এরকম ছন্নছাড়া জীবন যাপন করে খুব বেশিদিন টিকতে পারবেন না। তখনই প্রথম ঢুকে পড়েন জেলখানার হেঁসেলে, শুরু করেন রাঁধুনীর কাজ। এটিই তার ধীরে ধীরে একজন পাকা রাঁধুনী হয়ে ওঠার পেছনের গল্প।
অরটিজের ২৭ বছর আগের জীবনের সাথে এখনকার জীবনের কোন মিলই আর নেই। সে জীবনের বেশিরভাগ অনুষঙ্গই আর মিস করেন না তিনি। কিন্তু পরিবারের অভাববোধটা ঠিকই টের পান তিনি। পরিবার তার আছে বটে, কিন্তু দীর্ঘকাল জেলখানায় বন্দি থাকার ফলে তাদের সাথে বিশাল একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তার, যা ঘোচানো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব।
‘আমার মায়ের বয়স হয়েছে। বোন আছে, তিনি একজন শিক্ষিকা। এছাড়া আমার তিন সন্তান রয়েছেন। তারা যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমি খুব বড় একটা সময় তাদের থেকে দূরে ছিলাম। এর মধ্যে তারা তাদের জীবন নিজেদের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে। এখন আমি সেই জীবনে প্রবেশ করে তাদের সমস্যা সৃষ্টি করতে চাই না,’ এমনই নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অরটিজের।